হ্যালুসিনেশন
THRILLER রহস্যHORROR ভৌতিকSHORT STORY ছোটগল্প
তখনও যেন মাথার মধ্যে সেই মেয়েটার চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে। এ কি সত্যি স্বপ্ন নাকি অন্য কিছু। ভাবতে ভাবতেই পাঁশকুরা ঢুকে পড়ল ট্রেন। প্ল্যাটফর্ম এ নেমে দেখা গেল স্টেশনে বেশ হইচই হচ্ছে। এমনকি স্টেশনের কাছে মানুষ উৎসুক হয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে। ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেন বন্ধ। অন্যদিকে বালিচক লোকালের ঘোষণা হচ্ছে ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করার সময় তাদের নেই।
"আজও ট্রেন গন্ডগোল। তমলুক- পাঁশকুড়া লোকাল আজও সেই এক ঘন্টা লেট। তোমাদের এত করে বলি আমি একটা গাড়ি কিনলে যাতায়াতের কত সুবিধা হয় তোমরা কেউ বুঝতেই চাও না। একদম ফোন করবে না।" অত্যন্ত তিতিবিরক্ত স্বরে কথাগুলো বলে ফোন কেটে দিলেন অবিনাশ বাবু। সত্যিই সাউথ ইস্টার্ন এর এত গন্ডগোল যেন আর ভালো লাগছে না তাঁর। সকালে সেই যে সাত টা নাগাদ বাড়ি থেকে অফিসে আসেন আবার ফিরতে ফিরতে সেই রাত আট টা। শরীরেও কেমন যেন দিন দিন একটা ক্লান্তি বাসা বাঁধছে। রাতের ঘুমের সময়টাও বেশ কমে গেছে তাঁর। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই প্লাটফর্ম ধরে এগিয়ে চলতে থাকেন অবিনাশ মাইতি।
আজকে প্ল্যাটফর্মটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। লোকজনের তেমন আনাগোনা নেই। সকালে অবশ্য কোনো এক রাজনৈতিক দল চাক্কা জ্যাম এর বন্দোবস্ত করে সাধারণ মানুষের জীবন ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। তাই হয়তো আজকে মানুষজনের ভীড় নেই। সে অবশ্য একদিকে ভালো, আজকে একটু বসার জায়গা পাওয়া যাবে। হাঁটতে হাঁটতে একটা ঝালমুড়ির স্টল এর সামনে এসে থামলেন তিনি।
- দাদা একটা দাও তো দশের।
- ঝাল বেশি তো ?
- হ্যাঁ হ্যাঁ জানোই তো, রোজের খদ্দের।
- তোমার কাছে খুচরো হবে তো?
- আজ্ঞে না বাবু। আজকে লোক কম তো বিক্রি কম। আপনি পাশের দোকান থেকে করিয়ে দিলে ভালো হয়।
- আচ্ছা দাঁড়াও।
চৌধুরী স্টলের মালিকও আজ মাছি তাড়াচ্ছে। অবিনাশ বাবুকে দেখেই সহাস্যে বললেন,
- কি চাই বাবু?
- খুচরো হবে? একশো টাকা।
- হ্যাঁ হ্যাঁ হবে। কি নেবেন বলুন।
- একটা কাগজ দিন,একটা লিকার চা।
- আর কিছু নেবেন না?
- আর কটা চিপস এর প্যাকেট দিন আর বাকি টাকা ফেরত দিন।
স্টলের মালিকের থেকে খুচরো করিয়ে মুড়ি ওয়ালাকে টাকা দিয়ে পাশের বেঞ্চে গিয়ে ব্যাগ রেখে বসে পড়লেন অবিনাশ। দুহাত ভরে আছে জিনিসে। প্রথমে চা এর কাপটা তারপর মুড়ি আর চিপস এর প্যাকেট বেঞ্চে রেখে কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে চিপস এর প্যাকেটগুলো ব্যাগে ভরে, চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।
- আঃ !
********
-আরে অবিনাশ কতক্ষণ?
-আরে বিকাশদা , এসো এসো। বেশ অনেকক্ষণ গো। এই তো মুড়ি চা শেষ। তা তোমার আজ দেরি?
- তোমার মতো সরকারি চাকরি তো নয় ভায়া, বসের হুকুম তামিল না করলে মাস শেষে লবডঙ্কা।
- হা হা ... তা যা বলেছো।
- কাগজ টা দাও তো।
- এই নাও। তা চা খাবে নাকি ?
- ট্রেন আসতে আর কতক্ষণ?
ঘড়ি দেখে জবাব দেন অবিনাশ, " এই আর মিনিট দশেক।"
- নাহ্ তাহলে থাক।
********
আজকে ট্রেনটা বেশ ফাঁকা। হাত পা ছড়িয়ে বসে যাওয়া যাবে। ট্রেনে উঠেই জানালার ধারে একটা সিট বাগিয়ে নিলেন অবিনাশ আর বিকাশ। অবিনাশ আর বিকাশ প্রতিদিন পাঁশকুড়া থেকে তমলুক যাতায়াত করেন। আর যাতায়াতের পথেই তাদের জীবনের একটা বড় সময় কাটিয়ে দেন। নানান গল্প, আড্ডা, খাওয়া দাওয়া সবই চলতে থাকে ভীড়ের হট্টগোলে। অবশ্য আজ বেশ খোশ মেজাজেই বাড়ি ফিরছেন দুজনে। খবরের কাগজটা মুখের কাছে ধরে একের পর এক খবর পড়ে চলেছেন বিকাশ বাবু। অন্যদিকে ট্রেনের বাইরে থেকে আসা ফুরফুরে বাতাসে ঘুমের নেশা লাগে অবিনাশ বাবুর।
"জানো তো আজকে রঘুনাথ বাড়ির দিকে একটা অক্সিডেন্ট হয়েছে। একটা মেয়ে কাটা পড়েছে। কিগো ভায়া।" কাগজটা না সরিয়েই কথাগুলো বলছিলেন বিকাশ বাবু। উল্টোদিক থেকে উত্তর না আসায় এবার কাগজটা মুখ থেকে সরালেন। ততক্ষনে আধো ঘুমে ঢুলছেন অবিনাশ। বিকাশ বাবুর কথা পুরোটা না শুনেই " হুম হুম " জবাব দিয়ে নাকডাকা শুরু করলেন তিনি। অন্যদিকে বিকাশ বাবুও কাগজে মুখ গুঁজলেন পুনর্বার।
হঠাৎ ঘুমটা ভাঙল স্ত্রীর ফোনে। অবশ্য ফোনটা ধরতে গিয়ে কেটে গেছে। সামনে তাকিয়ে দেখলেন বিকাশ তখনও কাগজে মগ্ন। কামরার চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন লোকজন যে ক'জন ছিল সকলেই নেমে গেছে। শুধু একটি মেয়ে চুপচাপ বসে রয়েছে। বেশ অদ্ভুত লাগল তাঁর। মেয়েটির খোলা চুলে হাওয়ারা ঢেউ তুলেছে। মুখের ওপর খোলা চুল যেন তাকে বারবার বিরক্ত করার চেষ্টায় বিফল হচ্ছে। মুখটা ভালো ঠাওর হচ্ছে না। দেখে মনে হচ্ছে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে যেন অন্য জগতে চলে গেছে তার মন। এক নির্জীব পাথরের মূর্তির মত বসে আছে মেয়েটি। হয়তো ফাঁকা কামরায় খানিক ভীত হয়ে আছে। কিংবা দিবারাতের চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে।
ট্রেনটা এখন রাজগোদা ছেড়ে রঘুনাথবাড়ি ঢোকার পথে। অবিনাশ বাবু মেয়েটার থেকে চোখ ফিরিয়ে বিকাশবাবুর সাথে রাজনৈতিক তরজায় মত্ত। ট্রেনটা এখন তার সর্বোচ্চ গতি থেকে ধীরে ধীরে কমে আসছে, তবু বেশ জোরেই ছুটছে। মেয়েটা কখন ট্রেনের দরজার কাছে চলে এসেছে খেয়ালই করেন নি অবিনাশ বাবু। ট্রেনের ধারে মুখ বাড়িয়ে, খানিকটা শরীর টাকেও এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটা। হঠাৎ এক ভয়ঙ্কর আর্তনাদ। "আ আ আ আ... " ক্ষণিকের মধ্যে হাওয়াতে যেন ভেসে গেল শরীরটা। অবিনাশের বুকের মধ্যে যেন একটা গভীর নিস্তব্ধতা। কি যে হয়ে গেল কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না অবিনাশ। তাঁর যেন বাকশক্তি লোপ পেয়েছে। আপ্রাণ চেষ্টা করছেন বিকাশ বাবুকে ডাকতে কিন্তু তাঁকে যেন কোনো অশরীরী বস করেছে। সে হাত পা পর্যন্ত নাড়াতে পারছে না। প্রচন্ড ঘামে তাঁর সারা শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে।
***
- ভায়া ট্রেন পাঁশকুড়া ঢুকছে উঠে পড়।
বিকাশের ডাকে সম্বিত ফিরল তাঁর। জামাটা সত্যিই ঘামে ভিজে গেছে।
- কিগো ভালই ঘুম দিলে যে। এবার ওঠো।
- ওই মেয়েটা ....
- তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মেয়ের স্বপ্ন দেখছিলে নাকি!
- স্বপ্ন??
- হ্যাঁ সেই যে ঘুমিয়েছ মাঝে তো আর কোনো সাড়াই নেই। আমি কাগজ থেকে মুখ সরিয়ে দেখি তুমি তো নাক ডাকো হে।
তখনও যেন মাথার মধ্যে সেই মেয়েটার চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে। এ কি সত্যি স্বপ্ন নাকি অন্য কিছু। ভাবতে ভাবতেই পাঁশকুরা ঢুকে পড়ল ট্রেন। প্ল্যাটফর্ম এ নেমে দেখা গেল স্টেশনে বেশ হইচই হচ্ছে। এমনকি স্টেশনের কাছে মানুষ উৎসুক হয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে। ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেন বন্ধ। অন্যদিকে বালিচক লোকালের ঘোষণা হচ্ছে ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করার সময় তাদের নেই। দুজনেই শশগতিতে এগিয়ে গেলেন ওভারব্রীজ এর দিকে। ওপর থেকে নিচে দেখলেন একটা প্লাস্টিক মোড়া লম্বা কিছু একটা চার নম্বর লাইনের ওপর রাখা রয়েছে। প্লাস্টিক টা রক্তে লাল হয়ে আছে। কোনরকমে বলিচক লোকালে উঠতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। জানলার ধারে রক্তাক্ত প্যাকেট টা দেখে গা শিউরে উঠল সকলেরই। কেবল এক বৃদ্ধ বলে উঠল "কি নিষ্পাপ ছিল মেয়েটা; কেন যে ঝাঁপ দিল কে জানে। হরি বোল হরি বোল। " কথাটা শোনা মাত্রই অবিনাশের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। সারাটা রাস্তা একটা বাক্যউচ্চারণ করলেন না তিনি।